সোনালী জাতের মুরগী পালন

ভূমিকা


আমাদের দেশে মুরগী সম্পূর্ণ ছেড়ে-খাওয়ানো পদ্ধতিতে গ্রামীণ পারিবারিক পরিবেশে প্রায় বিনা খরচেই বছরে ৬০-৬৫টি ডিম দেয়। এ মুরগীগুলো প্রতি বার ডিম প্রদানের (১২-১৪টি) শেষে কুঁচে হয় এবং বাচ্চা ফুটিয়ে নিজের তত্ত্বাবধানে বাচ্চা লালন পালন করে। এদের ডিমের ওজন ৪০-৪৫ গ্রাম এবং তুলনামূলকভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশী। অপরদিকে, বিদেশী অধিক ডিম-প্রদানকারী মুরগী বছরে প্রায়-৩২০টি ডিম প্রদান করে এবং প্রতিটি ডিমের গড় ওজন ৫৮ গ্রাম। এ মুরগীগুলোর কুঁচে হওয়ার কৌলিক প্রবনতা নেই বললেই চলে তবে আমাদের দেশের আবহাওয়ায় রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই কম। এসব বাস্তব বিষয়সমূহ বিবেচনায় রেখে দেশী ডিম অপেক্ষা বেশী ওজনের অধিক সংখ্যক (১৫০-১৮০টি) ডিম পাওয়ার আশায় আমাদের দেশের প্রানিসম্পদ অধিদপ্তরে আর আই আর জাতের মোরগ এবং ফাউমি জাতের মুরগীর সংকরায়ণ ঘটিয়ে মধ্যম ওজনের হালকা সোনালী রঙের মুরগীর জাত উদ্ভাবন করা হয়। এ মুরগীগুলি এখন “সোনালী মুরগী” নামে পরিচিত। সোনালী জাতের মুরগীর বাচ্চা পালন এবং ডিম প্রদানকারী মুরগী পালনের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অনেকটা বিদেশী মুরগী পালন পদ্ধতির অনুরূপ। তদুপরি খামার পর্যায়ে অথবা সাধারণ পরিসরে সোনালী মুরগী পালনের প্রযুক্তিগত ধারণা দেয়ার প্রয়াসে “সোনালী জাতের মুরগী পালন” শীর্ষক প্রশ্নোত্তর পর্বে আলোকপাত করা হলো:


সংশ্লিষ্ট তথ্য


১. বাংলাদেশে উন্নত জাতের নির্দিষ্ট কোন মুরগীর জাত আছে কি?

• বাংলাদেশে উন্নত জাতের নির্দিষ্ট কোন মুরগীর জাত নেই।

২. বাংলাদেশের মুরগী বছরে সাধারণত কয়টি ডিম দেয়?

• দেশীয় মুরগী বছরে ৫০-৬০টি ডিম দেয়।

৩. দেশীয় মুরগীর গুণাগুণ কি কি?

• ডিম ও মাংস তুলনামূলকভাবে সুস্বাদু, রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই বেশি ও বাচ্চা পালন করা সুবিধাজনক।

৪. দেশীয় মুরগীর ডিম ও মাংসের পুষ্টিমানের কোন কমতি আছে কি?

• না, দেশীয় মুরগীর ডিম ও মাংসে চর্বি কম থাকে ও অন্যান্য পুষ্টিসমূহ যথাযথ পরিমাণেই আছে।

৫. ছয়-সাত সপ্তাহ বয়সের দেশীয় মোরগ-মুরগীর কত ওজন হতে পারে?

• মাত্র ২০০-৩০০ গ্রাম।

৬. দেশের সাধারণ ভোক্তাগণ অনেক সময় বিদেশী ডিম ও মাংস পছন্দ করেন না কেন?

• দেশীয মুরগীর ডিম-মাংস অধিক সুস্বাদু বিধায়।

৭. এ কারণে খামারীদের কোন সমস্যা হয় কি?

• অনেক সময় সমস্যা হয় এবং এক্ষেত্রে খামারীগণ দেশীয় মুরগীর কাছাকাছি অথবা আবহাওয়া-উপযোগী কিছুটা উন্নত জাতের মুরগী পালতে আগ্রহী হন।

৮. বিদেশী বাচ্চা আমদানীতে কি কি সমস্যা হতে পারে?

• রোগাক্রান্ত ও দূর্বল বাচ্চা দেশে রোগ বিস্তার করতে পারে এবং আশানুরূপ দৈহিক বৃদ্ধি ও ডিম উৎপাদন হয় না।

৯. দেশীয় মুরগীর জাতের পরিপূরক বা অনুরূপ কোন জাত সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে কি?

• ১৯৮৭ সালে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা মরহুম আব্দুল জলিল আম্বর সোনালী নামের এক জাতের মুরগী উদ্ভাবন করেছিলেন।

১০. সোনালী মুরগী কিভাবে এবং কোথায় সর্ব প্রথম উদ্ভাবন করা হয়েছিল?

• ঢাকাস্থ মিরপুরে অবস্থিত সরকারি কেন্দ্রীয় পোল্ট্রি ফার্মে ডিম-প্রদানকারী আর আই আর ( রোড আইল্যান্ড রেড) জাতের মুরগীর সাথে ডিম-উৎপাদনকারী মিশরীয় ফাই্উমি জাতের মুরগীর শংকরায়ণ ঘটিয়ে সোনালী জাতের মুরগীর সৃষ্টি হয়েছে।

১১. সোনালী জাতের মুরগী পালনের উপকারিতা কি কি?

• সোনালী জাতের মুরগী ছেড়ে পালন করা যায়, বছরে ১২৫-১৩০টি ডিম দেয়, দৈহিক ওজন প্রায় ১.৫ কেজি হয়, প্রতিটি ডিমের ওজন প্রায় ৫০ গ্রাম যা দেশীয় মুরগীর ডিমের অনুরূপ।

১২. সোনালী মুরগী তৈরির প্যারেন্টস্-স্টক (পিতা-মাতা) হিসাবে আর আই আর ও ফাইউমি জাতের মুরগী কোথায় পাওয়া যায়?

• মিরপুর সরকারী কেন্দ্রীয় পোল্ট্রি খামার ও বেসরকারী দু’একটি খামারে সোনালী মুরগীর জাত রক্ষিত আছে ও এদের বংশ বিস্তার করানো হয়।

১৩. একদিনের সোনালী মুরগীর বাচ্চাকে কি খাওয়ানো যেতে পারে?

• ব্রুডার বা তাপাধারের ভিতরে বিছানার উপর খবরের কাগজ বিছিয়ে তার উপর ভূট্টা, গম বা চালভাঙ্গা প্রথম ২-৩ দিন ছিটিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে।

১৪. খাবার সরবরাহের সময়ে বা তার আগে আর কি কি করণীয়?

• স্যালাইন পানি, ভিটামিন প্রিমিক্স ও ভিটামিন-সি দিনে ৩-৪ বার সরবরাহ করতে হবে।

১৫. সোনালী মুরগীর খাদ্য কি রকমের হয়?

• দেশীয় সকল খাদ্যসামগ্রীতে তৈরী অন্যান্য বানিজ্যিক খামারের সকল বয়সের মুরগীর অনুরূপ খাদ্য সরবরাহ করা যাবে।

১৬. রোগ-প্রতিরোধের জন্য কি করতে হবে?

• রোগমুক্ত বাচ্চা সংগ্রহ ও পালনের পাশাপাশি জীবনিরাপত্তার যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও সঠিক টিকা প্রদান করতে হবে।

১৭. বাচ্চা ঘরে তোলার আগে কি করতে হবে?

• প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হিসাবে প্রথম ২-৩ দিন রেনাকুইন, কসুমিক্স-প্লাস বা রেনামাইসিন ইত্যাদি এন্টিবায়োটিক খাওয়াতে হবে।

১৮. রোগমুক্ত রাখার জন্য কি কি ভ্যাকসিন ও ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে?

• বিসিআরডিবি, আরডিভি ও গামবোরো রোগের বিপরীতে ভ্যাকসিন ও এন্টিকক্সিডিয়াল ওষুধ দিতে হবে। চিকিৎসকের কথামত বুষ্টার ডোজ দিতে হবে।

১৯. সোনালী মুরগীকে কখন কৃমিনাশক খাওয়াতে হয়?

• সোনালী মুরগীর জন্মের ৩৫-৩৬ তম দিনে পাইপারজিন-সাইট্রেট-নামক কৃমিনাশক খাওয়ানো ভালো। সার্বক্ষণিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

২০. সোনালী মুরগীর ঘরের ব্যবস্থা কি রকম হতে পারে?

• অন্যান্য ডিমপাড়া মুরগীর ঘর ব্যবস্থাপনার অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

২১. দুই মাস যাবৎ প্রতিটি বাচ্চার জন্য কতটুকু খাবার লাগবে?

• প্রায় ১.৭৫ কেজি।

২২. সোনালী মুরগীর ওজন কতটুকু হতে পারে?

• প্রায় ৭০০-৮০০ গ্রাম।

২৩. দুই মাস পালন করে ১০০০ সোনালী মুরগীর বাচ্চা থেকে আনুমানিক কত টাকা লাভ হতে পারে?

• প্রায় ৭০,০০০.০০ টাকা লাভ হতে পারে।

২৪. সোনালী মুরগীর খামারের লাভ কিসের উপর নির্ভরশীল?

• বাচ্চা প্রাপ্তি, খাদ্যের মূল্য, মৃত্যুর হার, বাচ্চার দৈহিক বৃদ্ধি ও বাজার চাহিদার উপর।

২৫. সোনালী লেয়ার মুরগী থেকে কি পরিমাণ লাভ হতে পারে?

• পঁয়ত্রিশ-চল্লিশটি মুরগী থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৪,৫০০.০০ টাকা লাভ হতে পারে।

২৬. সোনালী মুরগীর পরিচিতির জন্য কি করতে হবে?

• সরকারি/বেসরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে সোনালী মুরগীর গুণাগুণ প্রচার করতে হবে ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা আবশ্যক।