বাছুর পালন
ভূমিকা
আজকের সদ্যপ্রসূত বাছুর বয়স বাড়ার সাথে বাড়ে বয়ঃসন্ধিক্ষণ প্রাপ্ত হয়ে আগামীতে বকনা কিংবা ষাঁড়ে পরিনত হবে। এই বকনা এবং ষাঁড়গুলো সঠিক যত্নের মাধ্যমে বড় হয়ে দুধালো গাভী ও প্রজনন উপযোগী ষাঁড় হবে। অকেজো বা অনুর্বর ষাঁড়গুলো খোজাকরণের মাধ্যমে বলদ বানালে জমি কর্ষণ কিংবা অপরাপর ভার বা পরিবহনের কাজে ব্যবহার করা যায়। একই সাথে অনুর্বর বকনাগুলো মোটাতাজাকরণের মাধ্যমে মাংস উৎপাদনের জন্য লালন পালন করা যাবে। এ বিষয়সমূহ মুখ্য বিবেচনায় রেখে জন্মের পর থেকে বয়ঃসন্ধিক্ষণ প্রাপ্তির আগ পর্যন্ত সার্বিক রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে লালন পালন করতে হবে। দুগ্ধ উৎপাদনকারী এবং গরু মোটাতাজাকরণে আগ্রহী খামারীদের বাছুর পালনের প্রযুক্তিগত ধারনা দেয়ার জন্য “বাছুর পালন” শীর্ষক প্রশ্নোত্তর পর্বের উপস্থাপনা করা হয়েছে:
সংশ্লিষ্ট তথ্য
১. বাছুর পালনের গুরুত্ব কতটুকু?
• বাছুরের মৃত্যুর হার কমাতে এবং সুস্থ সবল রাখতে বাছুর পালনে পরিচর্যার গুরুত্ব অনেক।
২. বাছুরের যত্ন না নিলে ভবিষ্যতে কি সমস্যা হতে পারে?
• আজকের বাছুর আগামীতে বড় হয়ে দুধালো গাভী বা ষাঁড় হবে।
৩. বাছুর পালনের প্রভাব কেমন হতে পারে?
• বাছুর ভালো স্বাস্থ্যবান হলে পরবর্তীতে গাভী হয়ে আশানুরূপ দুধ দেবে এবং ষাঁড় হলে প্রয়োজনে প্রজনন কাজে ব্যবহার করা যাবে।
৪. কখন থেকে বাছুরের যত্ন আরম্ভ করতে হবে?
• মায়ের গর্ভে থাকতেই পরোক্ষভাবে যত্ন আরম্ভ করতে হবে।
৫. গর্ভের কোন সময় যত্ন নিতে হবে?
• গর্ভধারণের শেষ তিন মাসে পর্যাপ্ত সুষম পুষ্টিকর খাদ্য গর্ভবতী গাভীকে খাওয়াতে হবে।
৬. এতে বাছুর কি সুবিধা পাবে?
• গাভীর নাড়ীর মাধ্যমে বাছুর প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ করে সুস্থ সবল অবস্থায় শারিরীকভাবে বৃদ্ধি পাবে।
৭. পরিমিত পুষ্টি সরবরাহ ছাড়া গর্ভবতী গাভীর জন্য আর কি করতে হবে?
• গর্ভকালের শেষ তিন মাসে ধীরে ধীরে দুধ দোহন বন্ধ করতে হবে।
৮. গর্ভবতী গাভীর আরাম আয়েশের জন্য কি করতে হবে?
• পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং পরিচ্ছ্ন্ন ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখতে হবে।
৯. গর্ভবতী গাভীকে পালের অন্যান্য গরুর সাথে রাখা ঠিক হবে কি?
• না, মারামারি বন্ধ রাখার স্বার্থে গর্ভবতী গাভীকে সম্পূর্ণ আলাদা রাখতে হবে।
১০. প্রসব নিকটবর্তী কাছাকাছি সময়ে গাভীকে কোথায় রাখতে হবে?
• প্রসব ঘরে গাভীকে সম্পূর্ণ আলাদা রাখতে হবে।
১১. বাছুর ভূমিষ্ট হওয়ার পরক্ষণেই কি ধরণের যত্ন নিতে হবে?
• পরিষ্কার শুকনা আলো-বাতাস-সমৃদ্ধ জায়গায় বাছুরের জন্ম হলে বাছুর স্বস্তিকর অবস্থায় থাকবে।
১২. প্রসবে বিঘ্নতা দেখা দিলে কি করতে হবে?
• প্রসবে অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই নিকটস্থ পশু চিকিৎসকের সহযোগিতা নিতে হবে।
১৩. বাছুর এবং গাভীর বিছানা কি রকম হতে হবে?
• শুকনো খড় পুরু করে বিছিয়ে খুব কাছাকাছি পর্যাপ্ত পরিমাণে হালকা ঠান্ডা বিশুদ্ধ পানি রাখতে হবে।
১৪. বাছুর ভূমিষ্ট হওয়ার সাথে সাথেই কি করতে হবে?
• শুকনো খড়কুটা, চট বা ছালার উপর রাখতে হবে। নাক ও মুখ হতে নিস্তৃত লালা পরিষ্কার করতে হবে।
১৫. নাকের ও মুখের লালা পরিষ্কার না করলে বাছুরের কি ক্ষতি হবে?
• শ্বাসরুদ্ধ হয়ে বাছুর মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
১৬. বাছুরের স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস না হলে কি করতে হবে?
• বাছুরের নাকে ও মুখে এবং নাভীতে ফুঁ দিলে প্রায় সময়েই শ্বাসপ্রশ্বাস চালু হয়ে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী শ্বাস বৃদ্ধির ঔষধ ব্যবহার করা ভালো।
১৭. বাছুরের নাড়ি কিভাবে কাটতে হয়?
• চামড়া থেকে ১-১.৫ ইঞ্চি রেখে কেটে যেকোন জীবাণুনাশক ব্যবহার করা জরুরী। নাভীতে যেন ধুলা-বালি কিংবা ময়লা না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
১৮. গাভী নিজে কিভাবে বাছুরের যত্ন নিতে পারে?
• বাছুরের শরীর তাড়াতাড়ি শুকানোর জন্য গাভী নিজেই জিহ্বা দিয়ে চাটে।
১৯. গাভী বা মালিকের কি করণীয় থাকে?
• শুকনা খড় বা কাপড় দ্বারা শরীর মুছে দেবেন। হালকা গরম পরিষ্কার পানি ঢেলে অথবা অন্য যেকোন সহজপ্রাপ্য জীবাণুনাশক-মিশ্রিত পানি দিয়ে বাছুরের শরীর মুছে দেবেন না।
২০. প্রসবের পরপরই বাছুরকে কি খাওয়াতে হবে?
• বাছুর দাঁড়ানোর চেষ্টা করার সাথে সাথেই তাকে শালদুধ খাওয়াতে হবে।
২১. প্রতিটি বাছুরের জন্য কতটুকু জায়গার প্রয়োজন?
• প্রতিটি বাছুরের জন্য ৬×৪ ফুট মাপের জায়গা প্রয়োজন।
২২. বাছুরের ঘরের বিছানা কি রকম হওয়া প্রয়োজন?
• পর্যাপ্ত পরিমাণ আলো-বাতাসসহ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঠিক রেখে শুকনা টুকরো খড় বা চট বিছানো যেতে পারে, ঘরের চোনা-গোবর সকাল বিকালে নিয়মিত সরাতে হবে।
২৩. সবল এবং দূর্বল বাছুর কি ঘরে এক সাথে রাখা যেতে পারে?
• সবল এবং দূর্বল বাছুর সব সময় আলাদা রাখতে হবে যাতে নিজেদের খাদ্য ও পানি নিজেরা খেতে পারে।
২৪. বাছুরের অন্যান্য সাধারণ যত্ন কি হতে পারে?
• সময়মত খাদ্য ও পানি সরবরাহপূর্বক যথাযথ সময়ে বয়সের ভিত্তিতে সকল রোগের জন্য টিকা প্রদান করতে হবে।
২৫. বড় খামারের একাধিক বাছুরকে সনাক্ত করার জন্য কি ব্যবস্থা নিতে হবে?
• গায়ে অথবা গলায় নম্বর লাগাতে হবে।
২৬. বাছুরের শিং কেন কাটা হয়?
• দূর্ঘটনা এড়ানো, কোন কোন সময় রোগ এড়ানো এবং পরবর্তীতে অল্প জায়গায় রাখার জন্য বাছুরের শিং কাটা হয়।
২৭. বাছুরকে খাওয়ানোর নিয়ম কি কি হতে পারে?
• জন্মের পর ৭ দিন, ৭ দিন থেকে দুধ ছাড়ানো (৫-৬ মাস) এবং দুধ ছাড়ানোর পরবর্তীতে অন্যান্য খাবার যথাযথভাবে খাওয়াতে হবে।
২৮. জন্মের পর সাত দিন কি কি খাওয়াতে হবে?
• কাঁচা দুধ বা শালদুধ খাওয়াতে হবে এবং অন্য কিছু না খাওয়ালেও হবে।
২৯. এক সপ্তাহ থেকে ৫-৬ মাস পর্যন্ত বাছুরকে কি ধরণের খাবার খাওয়াতে হবে?
• প্রয়োজনীয় আমিষ (১৬-১৮%), আঁশ-জাতীয় খাবার (৭-১০%), ক্যালসিয়াম (০.৬-০.৭%), ফসফরাস (০.০৪-০.০৫%), ম্যাগনেসিয়াম (০.১৫-০.২০%) এবং লবণ (০.০৭-০.০৮%) সমৃদ্ধ প্রাথমিক খাদ্য (কাফ স্টার্টার) খাওয়াতে হবে।
৩০. গর্ভধারণের আনুমানিক কত দিন পর বাচ্চা প্রসব হয়?
• প্রায় ২৭৪-২৯০ (গড় ২৮৪) দিনের মধ্যে।
৩১. জন্মের পর শালদুধ খাওয়ানোর নিয়ম কি?
• দৈহিক ওজনের ১০% হিসাবে অর্থাৎ ২০-২৫ কেজি ওজনের জন্য ১.২-১.৫ কেজি শালদুধ খাওয়াতে হবে।
৩২. দোহনের কতক্ষণ পর শালদুধ খাওয়াতে হবে?
• আধা ঘন্টা থেকে ১ ঘন্টার মধ্যে শালদুধ খাওয়াতে হবে।
৩৩. শালদুধ খাওয়ানোর উপকারিতা কি?
• শালদুধ রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
৩৪. জন্মের পর তিন মাস পর্যন্ত বাছুরকে কিভাবে দুধ খাওয়াতে হবে?
• প্রথম সপ্তাহের শেষ থেকে প্রতি ১০০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১০ কেজি হারে প্রতি সপ্তাহে ২ কেজি হিসাবে কমিয়ে ১২ সপ্তাহে দুধ খাওয়ানো বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে প্রতি সপ্তাহে ৫০০ গ্রাম হিসাবে দানাদার খাদ্য বাড়াতে হবে এবং এর সাথে পর্যাপ্ত কচি ঘাস দিতে হবে।
৩৫. বাছুরকে কি পরিমাণে দুধ খাওয়াতে হবে?
• প্রতি ১০০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ৮ কেজি হিসাবে দুধ খাওয়াতে হবে অর্থাৎ ৪০ কেজি ওজনের বাছুরকে ৩-৩.৫ কেজি দুধ খাওয়াতে হবে। এবাবে তিন মাস পর দুধ ছাড়াতে হবে।
৩৬. বাছুরকে কি পরিমাণে খড় খাওয়াতে হবে?
• দৈহিক ওজনের ১.৫% হিসাবে তিন মাস পর থেকে ঘাস/খড় খাওয়াতে হবে।
৩৭. ছয় মাসের পর থেকে বাড়ন্ত বাছুরকে কি পরিমাণ দানাদার খাদ্য খাওয়াতে হবে?
• দৈহিক ওজনের ১% হিসাবে দানাদার খাদ্য হিসাবে ইউ.এম.এস.(ইউরিয়া-মোলাসেস-স্ট্রসহযোগে প্রস্তুত সংরক্ষিত খড়) খাওয়ানো যেতে পারে।
৩৮. বাছুরের সাধারণত কি কি রোগ হয়?
• পেট ফাঁপা, ডিপথেরিয়া, এফএমডি, বদহজম, উদরাময়, নিউমোনিয়া, পাতলা পায়খানা, কোষ্ঠকাঠিন্য, সর্দি কাশি, উঁকুন, আঁঠালি, কৃমি, গলাফুঁলা ইত্যাদি।
৩৯. বাছুরের পেট ফাঁপে কেন?
• খাদ্যনালীতে কিছু আটকে গেলে বা কাদা-ধুলা-বালি খাদ্যের সাথে খেলে পেট ফাঁপে বা বদ হজম দেখা দিতে পারে।
৪০. পেট ফাঁপলে কি কি লক্ষণ দেখা দেয়?
• জাবরকাটা বন্ধ হয়, তাপ বেড়ে হয় ১০২-১০৪ ডিগ্রি ফা.।
৪১. পেট ফাঁপার কি কি চিকিৎসা আছে?
• খাদ্য বন্ধ রাখতে হবে ও শ্বাস কষ্ট না হওয়ার জন্য পশুকে ঢালু জায়গায় রাখতে হবে, প্রাথমিক চিকিৎসা হিসাবে পারগেটিভ বা কারমিনেটিভ মিশ্রণ খাওয়াতে হবে, প্রয়োজনে অভিজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা পেট ফুটো করে গ্যাস বের করতে হবে।
৪২. পাতলা পায়খানা আর উদরাময় কি?
• জীবাণুঘটিত বা বিষক্রিয়াজনিত কারণে পাতলা পায়খানা আর উদরাময় রোগ হতে পারে।
৪৩. পাতলা পায়খানা হলে বাছুরের কি অবস্থা হয়?
• বাছুরের শরীর তাড়াতাড়ি শুকানোর জন্য গাভী নিজেই জিহ্বা দিয়ে চাটে।
৪৪. পাতলা পায়খানা হলে কি ব্যবস্থা নিতে হবে?
• সালফার ট্যাবলেট খাওয়ানো যেতে পারে, দূর্বলতার জন্য স্যালাইন অথবা গ্লুকোজ ইনজেকশন দেয়া যেতে পারে।
৪৫. কোষ্ঠকাঠিন্য কি?
• বাছুরের পায়খানা আটকে যাবে, পায়খানা শক্ত ও পরিমাণে কম হবে, পেটে ব্যথা হবে ও ফুলে যাবে।
৪৬. বাছুরের কোষ্ঠকাঠিন্য হলে কি করা দরকার?
• ভেরেন্ডার তৈল এবং তিষির তৈল খাওয়ালে উপকার পাওয়া যাবে। এছাড়া লবণ ও পানিসহ ম্যাগসালফ, ম্যাগকারব বা অন্যান্য সহজপ্রাপ্য পারগেটিভের মিশ্রণ বাছুরকে খাওয়ানো যেতে পারে।
৪৭. বাছুরের সর্দি-কাশি কেন হয়?
• প্রতিকূল আবহাওয়ায় অতি ঠান্ডা, বৃষ্টিতে ভেজা, প্রখর রোদে চলাচল, রোগ-জীবাণুর প্রাদুর্ভাব ইত্যাদি কারণে সর্দি-কাশি হতে পারে।
৪৮. বাছুরের সর্দি-কাশির লক্ষণ কি কি?
• শরীরে ব্যথা ও জ্বরসহ নাকে পানি পড়া এবং মাঝে মাঝে হাঁচি দেখা দিতে পারে।
৪৯. সর্দি-কাশি হলে কি কি করণীয়?
• শুকনো জায়গায় ও আলো-বাতাসে বাছুরকে রাখতে হবে, বাজারে সহজপ্রাপ্য সালফার-জাতীয় ট্যাবলেট চিকিৎসকের পরামর্শ মত খাওয়াতে হবে। এছাড়া সামান্য গরম সরিষার তৈল, ক্যামফর বা তারপিন মলম দুই পাজরে মালিশ করা যেতে পারে।
৫০. বাছুরের শরীরে কেন উঁকুন দেখা দেয়?
• উঁকুন এক প্রকার বহিঃপরজীবি যা থাকলে শরীরের লোম উসকোখুসকো দেখায় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে লোম ঝরে পড়ে, চুলকানির ফলে শরীর ঘষাঘষি করে চামড়ার বেশ ক্ষতি হয়, স্বাভাবিক বৃদ্ধি কমে এবং রক্তশূণ্যতা দেখা দিতে পারে।
৫১. উঁকুনের ধ্বংস কিভাবে করা যায়?
• নেগুভন, নাগামেন্ট, গ্যামাক্সিন, এসানটল বা অন্যান্য ঔষধ পশু-চিকিৎসকের পরামর্শ মতে খাওয়ানো যেতে পারে।
৫২. আাঁঠালী দ্বারা বাছুর আক্রান্ত হলে কি কি ক্ষতি হয়?
• আঁঠালী এক প্রকার বহিঃপরজীবি যা বাছুরের শরীরের রক্ত চুষে খায় এবং এর ফলে বাছুরের চরম স্বাস্থ্য হানি ঘটে।
৫৩. আঁঠালী ধ্বংস করার জন্য সহজ উপায় কি কি?
• আঁঠালী এবং উঁকুন উভয় দ্বারা আক্রান্ত হলে পশুকে ৫% ম্যালাথিয়ন বা অন্য যেকোন কীটনাশক দ্রবণে খামারের সকল বাছুরকে একই সাথে গোছল করাতে হবে। খামার পরিষ্কার করে সব আবর্জনা পুড়িয়ে খামারে জীবাণুনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
৫৪. কখন এবং কি ধরণের কৃমিতে বাছুর আক্রান্ত হয়?
• জন্মের আগে বা পরে বাছুর বিভিন্ন প্রকার কৃমি দ্বারা (লম্বা, গোল, সুতা, চ্যাপ্টা বা ফিতা কৃমি উল্লেখযোগ্য) আক্রান্ত হতে পারে।
৫৫. কৃমি বাছুরের শরীরে কোথায় অবস্থান নেয়?
• পাকস্থলী, খাদ্যনালী, কলিজা ও ফুসফুসে কৃমি বসবাস করে।
৫৬. কৃমি কিভাবে বাছুরের দেহে প্রবেশ করে?
• চারণ-ভূমির ঘাস বা বাসস্থানের আক্রান্ত পশুর পায়খানা থেকে কৃমি বিস্তার লাভ করে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে চামড়া ভেদ করে কৃমি শরীরে প্রবেশ করে।
৫৭. কৃমিতে আক্রান্ত পশুর মধ্যে কি কি লক্ষণ দেখা দেয়?
• স্বাস্থ্যের অবনতিতে ওজন কমে যায়। খাদ্য হজম কমে যায়, লোম উস্কোখুসকো হয়ে যায়, রক্তশূণ্যতা দেখা যায়, দূর্বলতা বাড়ে ও খাওয়া কমে ক্রমাণ্বয়ে হাড্ডিসার হয়ে যায়, কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয় ও চোয়ালের নিচে পানি জমে যায়।
৫৮. কৃমি দমনের জন্য কি কি ঔষধ খাওয়ানো যেতে পারে?
• কৃমির ধরণ অনুসারে চিকিৎসকের পরামর্শমতে বাজারেপ্রাপ্ত ঔষধ খাওয়াতে হবে। সুস্থ ও অসুস্থ সব বাছুরকে একই সাথে ঔষধ খাওয়াতে হবে।
৫৯. বাছুরের সাদা উদরাময় রোগ বলতে কি বুঝায়?
• সাধারণত দু’সপ্তাহের কম বয়সের বাছুরের সাদা পাতলা পায়খানা হলে তাকে সাদা উদরাময় বা কাফ স্কাউয়োর রোগ বলা হয়।
৬০. কি কি কারণে সাদা উদরাময় রোগ হতে পারে?
• খারাপ ব্যবস্থাপনা, নিয়ম বহির্ভূত কৃত্রিম উপায়ে খাওয়ানো, শালদুধের অভাব, অতিমাত্রায় ও অনিয়মিতভাবে দুধ খাওয়ানো, অত্যধিক ঠান্ডা দুধ খাওয়ানো, রসদে সবুজ খাদ্যের স্বল্পতা ইত্যাদি কারণে এবং এসকারেসিয়া কলাই নামক জীবাণু দ্বারা সাধারণত মানুষ বা পশুর খাদ্যনালীতে এ রোগ হতে পারে।
৬১. সাদা উদরাময় রোগ কিভাবে চেনা যাবে?
• ঘনঘন মল ত্যাগ, চালের পানির মত পাতলা দূর্গন্ধযুক্ত পায়খানা, প্রথম দিকে জ্বর হয়ে পরে স্বাভাবিক মাত্রার নিচে তাপমাত্রা নেমে যায়, খাওয়াতে অরুচি এবং আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে বাছুর মারা যায়।
৬২. সাদা উদরাময় রোগের চিকিৎসা ও প্রতিকারের উপায় কি?
• লক্ষণ বুঝার সাথে সাথে ২৪ ঘন্টার মধ্যে খাদ্য বন্ধ করতে হবে। সামান্য গরম পানিতে গম অথবা ভূট্টার কুঁড়া খাওয়ানোর পাশাপাশি দুধ খাওয়ানোর পরিমাণ বাড়াতে হবে। স্যালাইন ও পরামর্শ অনুযায়ী সালফার-জাতীয় ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল খাওয়াতে হবে বা ইনজেকশন দিতে হবে। জন্মের পরপরই শালদুধ খাওয়াতে হবে এবং জীবাণুমুক্ত ও পরিষ্কার জায়গায় বাছুরকে রাখতে হবে।
৬৩. নিউমোনিয়া রোগ কেন হয়?
• ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাক এবং রাসায়নিক দ্রব্য দ্বারা এ রোগ হতে পারে।
৬৪. নিউমোনিয়া রোগের সাধারণ লক্ষণসমূহ কি কি?
• শ্বাস-প্রশ্বাসের মাত্রা বাড়ে, শ্বাস-প্রশ্বাসে অস্বাভাবিক শব্দ হয়, জ্বর হয়, সর্দি বাড়ে ও অবস্থার প্রেক্ষাপটে লক্ষণ ভিন্ন হতে পারে। নিউমোনিয়ার অপর নাম শ্বাস রোগ বা পাঁজর ব্যথা।
৬৫. নিউমোনিয়া রোগের চিকিৎসা কি হতে পারে?
• পশু-চিকিৎসকের পরামর্শমতে অতি সাবধানতায় বাছুরের শিরায় অথবা মাংসপেশীতে এন্টিবায়োটিক ইনজেকশন দিতে হবে ও একই সাথে এন্টিহিস্টামিনিক ইনজেকশন নির্ধারিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
৬৬. ডিপথেরিয়া রোগ বলতে কোন রোগকে বুঝায়?
• ডিপথেরিয়া রোগটি স্ফেরোফোরাস নেক্রোফেরাস জীবাণুর সৃষ্ট একটি মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি যার মাধ্যমে তিন মাসের বাছুরের মুখগহ্বর এবং বেশি বয়সের বাছুরের ল্যারিংস আক্রান্ত হয়।
৬৭. ডিপথেরিয়া রোগ চেনার উপায় কি কি?
• জ্বর ও মুখে লালা পড়ে, দুধ খেতে পারে না, মুখে গোঙানির মত ঘড় ঘড় শব্দ হয়। শেষ পর্যায়ে নাক থেকে পানি পড়ে, জিহ্বা বের হয়ে থাকে এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মাত্রা বেড়ে যায়।
৬৮. ডিপথেরিয়া রোগের চিকিৎসা ও প্রতিকার কি কি হতে পারে?
• শক্ত খাবার বন্ধ করতে হবে এবং পশু-চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সালফানিলামাইড ও এন্টিবায়োটিক দ্বারা চিকিৎসা করা যেতে পারে।
৬৯. ক্ষুরা রোগ বলতে কোন রোগকে বুঝায়?
• ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ যার ফলে মুখে ও পায়ে এক সাথে ঘা বা ক্ষতের সৃষ্টি হয়। চার ধরণের ভাইরাস দ্বারা এ রোগের সৃষ্টি হয়।
৭০. ক্ষুরা রোগ আর কোন কোন নামে পরিচিত?
• এলাকা ভেদে ক্ষুরা রোগের প্রচলিত নাম জ্বরা, পাতা, তাপা, ক্ষুরা পাকা ইত্যাদি।
৭১. ক্ষুরা রোগ সংক্রমিত হয় কিভাবে?
• দূষিত খাদ্য, পানি, বাতাস বা আক্রান্ত পশুর সংস্পর্শের মাধ্যমে সুস্থ দেহে এ রোগ সংক্রমিত হয়।
৭২. ক্ষুরা রোগের লক্ষণসমূহ কি কি?
• প্রথমে জ্বর দেখা দেয়, তাপমাত্রা বেড়ে ১০৫ ডিগ্রি ফা. উঠে, মুখে বিরামহীন লালা পড়ে, কোন কোন সময় মুখে চপচপ শব্দ হয়, জিহ্বা, মুখ ও ক্ষুরের মাঝখানে ফোঁসকা পড়ে, পরে ফেঁটে ঘা বা ক্ষত সৃষ্টি হয়, আক্রান্ত বাছুর অনেক ক্ষেত্রেই মারা যায়।
৭৩. ক্ষুরা রোগের চিকিৎসা কি কি হতে পারে?
• ফিটকিরির পানিতে মুখ ও পায়ের ঘা ধুতে হবে, একটি ট্রাইসালফার ট্যাবলেট ৩৫ লিটার পানিতে গুলিয়ে দিনে একবার খাওয়াতে হবে, পরের দিন হতে অর্ধেক মাত্রায় পর পর তিন দিন খাওয়াতে হবে, আক্রান্ত বাছুরকে তরল বা নরম খাবার খাওয়াতে হবে, গুরুতর অবস্থায় পশু-চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
৭৪. ক্ষুরা রোগ প্রতিরোধের উপায় কি?
• রোগের লক্ষণ ও ভাইরাসের প্রকার বিবেচনা করে প্রতিষেধক টিকা প্রদান করতে হবে। আক্রান্ত গরু থেকে সুস্থ গরুকে বা অন্যান্য পশুকে আলাদা রাখতে হবে। রোগ বিস্তারের সকল বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
৭৫. বাদলা রোগ কি এবং বাদলা রোগ অন্য কি নামে পরিচিত?
• ক্লস্ট্রিড়িয়াম সোভিয়াই নামক ব্যাক্টেরিয়া দ্বারা ৬-২৪ মাস বয়সের গরুতে সৃষ্ট একটি মারাত্মক ব্যাধি। এ ব্যাধিতে মাংসে প্রদাহ ও রক্তশূণ্যতা দেখা দেয়। বিকিউ, ব্লাকলেগ এবং ব্ল্যাক কোয়াটার নামেও এ রোগ পরিচিত।
৭৬. বাদলা রোগ কিভাবে সংক্রমিত হতে পারে?
• দূষিত খাদ্য ও পানির মাধ্যমে সুস্থ বাছুরের দেহে এ রোগ সংক্রমিত হয়।
৭৭. বাদলা রোগের সাধারণ লক্ষণ কি কি হতে পারে?
• তাপমাত্রা বেশ (১০৫-১০৭ ডিগ্রি ফা.) বেড়ে যায়, সামনের বা পিছনের একটি বা দুটি পায়ের সামনে বা পিছনের উপরে মাংসালো জায়গা ফুলে যায়। প্রথমে গরম ও বেদনাদায়ক থাকে, পরে ঠান্ডা ও ব্যথাহীন হয়, ফুলা জায়গায় চাপ দিলে পচপচ বা ফড়ফড় শব্দ করে। এ রোগের প্রধান লক্ষণ কোষ্ঠকাঠিন্যতা, পশু খুড়িয়ে হাটে, আস্তে আস্তে দূর্বল হয়ে অবশেষে মারা যায়।
৭৮. বাদলা রোগের চিকিৎসা কি হতে পারে?
• সময়মত সালফার-জাতীয় ঔষধ বা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এন্টিবায়োটিক শিরায় প্রয়োগ করলে আক্রান্ত গরুটি ভালো হতে পারে, ফুলা স্থানে গরম ছেক দিলে এবং পশু চিকিৎসক দ্বারা চামড়া কেটে দিলে রোগের প্রখরতা কমে থাকে।
৭৯. বাদলা রোগের প্রতিরোধ ব্যবস্থা কি হতে পারে?
• সুস্থাবস্থায় সময়মত প্রতিরোধক টিকা দিতে হবে।
৮০. বাদলা রোগের টিকা কি কি নিয়মে দিতে হবে?
• তিন থেকে ৩৬ মাস বয়সী গরুকে ৫ মি.লি. হিসাবে কাঁধ বা ঘাড়ের চামড়ার নিচে টিকা প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি ছয় মাস পরপর এই টিকা প্রদান করতে হবে। টিকার বোতল খোলার ২৪ ঘন্টা পর এই টিকা আর প্রয়োগ করা যাবে না। রেফ্রিজারেটরে ৪-৮ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় টিকা সংরক্ষণ করতে হবে।
৮১. গলাফুলা বা হেমরহেজিক সেপটিসেমিয়া রোগ কি?
• পাষ্টুরেলা মালটোসিডা এবং পাস্টুরেলা হিমোলাইটিকা নামক ব্যাক্টেরিয়া দ্বারা এই রোগটি সংক্রমিত হয়। আমাদের দেশে সাধারণত বর্ষার আগে বা শেষে অতি তীব্র পর্যায়ে এ রোগ পরিলক্ষিত হয়। ছোঁয়াচে এবং সংক্রমিত উক্ত রোগটি এলাকা ভেদে বাংলা, ঘটু, গলঘুট, ঘলবেরা ইত্যাদি নামে পরিচিত।
৮২. গলাফুলা রোগের বিস্তার কিভাবে ঘটে?
• দূষিত খাদ্য ও পানির মাধ্যমে সুস্থ দেহে রোগের জীবাণু প্রবেশ করে।
৮৩. গলাফুলা রোগ চেনার উপায় কি?
• তীব্র রোগে আক্রান্ত হয়ে লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াই গরু মারা যায়। দৈহিক তাপমাত্রা ১০৫-১০৭ ডিগ্রি ফা. বাড়ে, গলা ফুলে যায়, ফুলা জায়গা গরম হয়, ফুলা আস্তে আস্তে বেড়ে বুক পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে, শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হয় এবং আওয়াজ শোনা যায়, জিহ্বা ফুলে যায়, সময় সময় হা করে জিহ্বা বের করে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করে, অনেক সময় কাশি হয়, চোখে পিচুটি দেখা যায়, নাক থেকে সাদা শ্লেষা পড়তে থাকে, পানাহার বন্ধ করে দেয় এবং ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে পশু মারা যায়।
৮৪. গলাফুলা রোগের চিকিৎসা কি?
• মাংসপেশিতে প্রতি ১০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১ মি.লি. অক্সিটেট্রাসাইক্লিন ইনজেকশন দিতে হবে এবং ৭২ ঘন্টা পরে আর একটি ইনজেকশন দিতে হবে। গলার পাশে ঢিলা চামড়ার নিচে ১ মি.লি. হিসাবে ১ বছর পর পর টিকা দিতে হবে।
৮৫. টিকা প্রদানের ক্ষেত্রে কি কি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে?
• শুধুমাত্র সুস্থ গরুকেই গলাফুলা রোগের টিকা দেয়া উচিত। টিকা প্রয়োগের স্থান কয়েকদিন ফুলা থাকতে পারে, সাথে সাথে দেহের তাপমাত্রাও সামান্য বাড়তে পারে। ৪ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় রেফ্রিজারেটরে টিকা সংরক্ষণ করতে হবে।
৮৬. তড়কা রোগের পরিচয় কি?
• তড়কা একটি অতি তীব্র সংক্রামক রোগ যার লক্ষণ মারা না-যাওয়া পর্যন্ত বুঝা যায় না। ব্যাসিলাস এনথ্রোসিস নামক ব্যাক্টেরিয়া দ্বারা এ রোগ সংক্রমিত হয়।
৮৭. কি কি লক্ষণ দেখে তড়কা রোগ সনাক্ত করা যায়?
• মারা যাওয়ার আগ মুহুর্ত বা পরে নাক, মুখ, মলদ্বার ইত্যাদি দিয়ে আলকাতরার রঙের ন্যায় তরল রক্তমিশ্রিত রস নির্গত হতে থাকে, তড়কা রোগে মৃত পশুর রক্ত জমাট বাধে না।
৮৮. কিভাবে তড়কা রোগ বিস্তার লাভ করতে পারে?
• দূষিত পানি ও খাদ্যের মাধ্যমে এবং সঠিক জীবনিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে তড়কা রোগ বিস্তার লাভ করে।
৮৯. তড়কা রোগের লক্ষণ কি কি হতে পারে?
• তীব্র রোগে আক্রান্ত হয়ে পশু হঠাৎ মারা যায়, অনেক সময় কোন লক্ষণ দেখা যায় না, অত্যধিক জ্বর (১০৫-১০৭ ডিগ্রি ফা.) উঠে, লোম দাঁড়িয়ে থাকে, শরীর কাঁপে, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত মাত্রায় বাড়ে এবং গভীর হয়। মাথা নিচু করে দাঁড়ায়, কিছুটা উত্তেজিত দেখায়, এক সময় নিস্তেজ হয়ে খিচুনি হয় এবং মারা যায়।
৯০. কিভাবে তড়কা রোগের চিকিৎসা করা হয়?
• পশু-চিকিৎসকের পরমর্শমতে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এন্টিবায়োটিক দিলে ভালো ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। তড়কা রোগাক্রান্ত পশু কোন চিকিৎসাতে সুস্থ হয় কিনা তা জানা নেই।
৯১. তড়কা রোগের প্রতিরোধের কি কি ব্যবস্থা নিতে হবে?
• শুধুমাত্র সুস্থ পশুকে যথাসময়ে টিকা প্রদান করতে হবে, গলার চামড়ার নিচে ০.৫ মি.লি. হিসাবে টিকা প্রয়োগ করতে হবে এবং প্রতি বছর টিকা দিতে হবে। টিকা প্রদানের স্থান কয়েকদিন ফুলা থাকতে পারে। শরীরের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে। ৪-৫ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় টিকা সংরক্ষণ করতে হবে।
৯২. বাছুরের স্বাস্থ্য-বিধি পালন কি রকমের হতে পারে?