ককরেল পালন
ভূমিকা
ডিম উৎপাদনকারী মুরগীর বাচ্চা ফুটানোর ক্ষেত্রে পোল্ট্রি হ্যাচারিতে বাস্তবে লক্ষ্য করা যায় যে, আশানুরূপ সংখ্যক স্ত্রী বাচ্চার সাথে বেশ কিছু সংখ্যক পুরুষ বাচ্চা ফুটে থাকে। ওই পুরুষ বাচ্চাগুলো ইতিপূর্বে পরিত্যাগপূর্বক মেরে ফেলা হত। কিন্তু বর্তমানে ক্রমবর্দ্ধমান আমিষের চাহিদা মেটানোর পরিপ্রেক্ষিতে হ্যাচারিতে প্রষ্ফুটিত পুরুষ মুরগির বাচ্চাগুলো পালনের জন্য উৎসাহী বাণিজ্যিক খামারীদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে বিক্রয় করা হচ্ছে । ডিমপাড়া মুরগীর বাচ্চা পালনের প্রায় অনুরূপ ব্যবস্থাপনায় ৮-১০ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত মাংস প্রদানকারী ককরেল হিসাবে পালন করে সফল খামারীগণ আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু সম্প্রতি জানা যাচ্ছে যে, প্রযুক্তিগত ধারনার অভাবে খামারীগণ কোন কোন ক্ষেত্রে তেমন মুনাফা অর্জন করতে পারছেন না। এ বিষয়টি সরল বিবেচনায় রেখে ককরেল পালনকারীদের প্রযুক্তিগত সাধারণ ধারণা প্রদানের প্রয়াসে “ককরেল পালন” শীর্ষক প্রশ্নোত্তর পর্বের আলোকপাত করা হলো:
সংশ্লিষ্ট তথ্য
১. ককরেল বলতে কি ধরণের মুরগি বুঝায়?
• ডিমপাড়া মুরগীর বাচ্চা উৎপাদনের সময় হ্যাচারীতে প্রায় ৫০% স্ত্রী বাচ্চা আর ৫০% পুরুষ বাচ্চা পাওয়া যায়। প্রায় ৮ সপ্তাহ বয়সের এই পুরুষ বাচ্চাকে বিশেষ যত্নে পালার পর তাকে ককরেল বলা হয়।
২. কেন ককরেল পালা হয়?
• স্ত্রী বাচ্চাগুলো ডিম উৎপাদন করার জন্য পালা হয় আর পৃরুষ বাচ্চাগুলোর বাজারজাতকরণের সুযোগ কম থাকায় না মেরে অপেক্ষাকৃত সস্তায় মাংস উৎপাদন করার জন্য পালা হয়।
৩. ককরেলকে আর অন্য কোন নামে ডাকা হয়?
• কোন কোন স্থানে বা ক্ষেত্রে তাদেরকে কক বলা হয়।
৪. ককরেল কোন কোন পরিবেশে বা স্থানে পালা যায়?
• বিদ্যুৎ সবরাহ না থাকলেও গ্রামে এবং শহরে উভয় স্থানেই ককরেল পালা যায়।
৫. ককরেল পালনের সুবিধা কি কি?
• সহজে ও সস্তায় একদিন বয়সের বাচ্চা পাওয়া যায়, বাচ্চার দৈহিক ওজন অনেকটা বেশি, খাদ্য দক্ষতা বেশি বলে লাভজনক এবং ক্রেতাগণ দেশীয় মোরগের মত মনে করে ক্রয় করে থাকেন।
৬. একদিন বয়সের ককরেল বাচ্চার দাম কত হতে পারে?
• প্রায় ১০-১২ টাকা।
৭. কোন বয়সে ককরেল বাজারজাতকরা যেতে পারে?
• ককরেলের বয়স ৮-৯ সপ্তাহের হলে সেগুলো বাজারজাতকরা যেতে পারে।
৮. ককরেল পালন কেন বেশি লাভজনক?
• উৎপাদন খরচ কম, ক্রেতার চাহিদা এবং তুলনামুলকভাবে বাজার মূল্য বেশি।
৯. ককরেল পালনে তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি কি রকম?
• অনেক কম।
১০. ককরেলের মুত্যুর হার কম কেন?
• ককরেলের বাচ্চার রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা সাধারণত বেশি থাকে।
১১. মাংসের গুণাগুণ কি রকম?
• মাংসে চর্বি কম এবং অন্যান্য পুষ্টির উপস্থিতিও ভালো।
১২. ককরেলের মাংসের স্বাদ কেমন?
• অনেকটাই দেশীয় মোরগের মত।
১৩. ককরেল কিভাবে খাওয়া যায়?
• ব্রয়লার মুরগীর মতই খাওয়া যায় তবে বর্তমানে ককরেলের তৈরি রোষ্ট সকল অনুষ্ঠানেই বিশেষভাবে সমাদৃত।
১৪. ককরেল পালনে কি ধরণের প্রস্তুতি নিতে হবে?
• দ্রুত-বর্ধণশিল বাচ্চার জাত নির্বাচন ও ব্রয়লার পালনের অনুরূপ অন্যান্য সকল অত্যাবশ্যকীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১৫. ককরেল পালনের জন্য বাচ্চা কোথায় পাওয়া যাবে?
• বানিজ্যিক পোল্ট্রি হ্যাচারি থেকে সঠিক যোগাযোগের মাধ্যমে ককরেলের বাচ্চা সংগ্রহ করা যাবে।
১৬. কোন রঙের বাচ্চা সংগ্রহ করা উত্তম?
• ক্রেতার পছন্দ আর চাহিদা বেশি হওয়ায় বাদামী বা লালচে রঙের বাচ্চা সংগ্রহ করা ভালো।
১৭. বর্তমানে সাধারণত কোন কোন জাতের বাচ্চা সংগ্রহ করা হয়ে থাকে?
• হাই-লাইন ব্রাউন, হাই-সেক্স ব্রাউন, স্টারক্রস-৫৭৯ এবং বিভি-৩০০ জাতসহ আরও কিছু সংখ্যক জাতের বাচ্চা পাওয়া যায়।এছাড়ও দেশের প্রায় ২০টি হ্যাচারী থেকে অন্যান্য জাতের ককরেলের বাচ্চা সংগ্রহ করা যাবে।
১৮. ককরেল পালনের সম্ভাব্য পূর্ব প্রস্তুতি কি হতে পারে?
• বাচ্চা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, বাসস্থান, দানা-পানি, সব রকম জৈবনিরাপত্তা ও বাজারজাতকরণের নিশ্চয়তা থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্রয়লার পালনের যে পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া হয় তা অনুসরণ করা ভাল হবে।
১৯. কি কি পদ্ধতিতে ককরেল পালা যায়?
• খাঁচা এবং মেঝে উভয় পদ্ধতিতে ককরেল পালা যায়।
২০. একটি ককরেল পালতে কোন পদ্ধতিতে কতটুকু জায়গা লাগে?
• উভয় পদ্ধতিতে ৯ সপ্তাহ পর্যন্ত পালতে প্রায় ৭৫০ ব.সে. জায়গার প্রয়োজন তবে বিছানা/লিটার পদ্ধতিতে প্রতি ককরেলের জন্য ১ব.ফু. জায়গা রাখা ভালো।
২১. ককরেলের জন্য বাজারে তৈরি খাবার পাওয়া যায় কি?
• খুব কম সংখ্যক পোল্ট্রি খাদ্য ব্যবসায়ী ককরেলের খাদ্য তৈরি করেন।
২২. ককরেলের খাদ্য খামার মালিকগণ তৈরি করতে পারবেন কি?
• খাদ্য সূত্রায়ণের তথ্য জেনে ও প্রয়োজনীয় পুষ্টিমাত্রা রক্ষা করে খামার মালিকগণ ককরেলের খাদ্য তৈরি করতে পারবেন।
২৩. খাদ্য তৈরির ক্ষেত্রে কোন কোন পুষ্টির গুরুত্ব বেশি?
• খাদ্যে আমিষের শতাংশ এবং প্রতি কেজিতে বিপাকীয় শক্তির পরিমাণ বেশি গুরুত্ব পাবে।
২৪. খাবারে কী পরিমাণ আমিষ আর বিপাকীয় শক্তি থাকতে হবে?
• ককরেল পালনে (নয় সপ্তাহ পর্যন্ত) এক ধরণের খাদ্যই খাওয়ানো হয়ে থাকে বিধায় খাদ্যে ২০-২১% আমিষ এবং প্রতি কেজিতে ২৮০০-২৯০০ কিলো-ক্যালরী শক্তি থাকা ভালো।
২৫. সুষম খাদ্য তৈরিতে কিভাবে খরচ কমানো যাবে?
• আমিষ-সমৃদ্ধ সামগ্রীর দাম ও প্রয়োগের মাত্রা বিশেষ বিবেচনায় রাখতে হবে।
২৬. বাজারে প্রস্ততকৃত খাদ্য খাওয়ানো যাবে কি?
• পুষ্টিমান আর খাদ্য যথাযথ মাত্রায় থাকলে খাওয়ানো যেতে পারে।
২৭. একটি ককরেল প্রতিদিন সাধারণত কতটুকু খাবার খায়?
• আট গ্রাম থেকে আরম্ভ করে প্রতি সপ্তাহে প্রতিদিন প্রায় ৪-৫ গ্রাম বাড়িয়ে নয় সপ্তাহে প্রতিদিন প্রায় ৫০ গ্রাম খাবার খায়।
২৮. ককরেলের খাদ্যের মিশ্রণ কি রকম হতে হবে?
• অন্যান্য বাচ্চা/বাড়ন্ত পোল্ট্রির মতই ৪৫-৫০% দানাদার সামগ্রী রাখতে হবে।
২৯. কিভাবে প্রতি ১০০ কেজি খাদ্যের দাম কমানো যাবে?
• অধিক মূল্যের সামগ্রী এবং অমিষ-সমৃদ্ধ সামগ্রীর মাত্রা সাধ্যমত কম রাখতে হবে।
৩০. ককরেলের খাদ্য রূপান্তর ক্ষমতা কি রকম?
• সঠিক বলা যায় না তবে ৮-৯ সপ্তাহে একটি ককরেল ৭৫০-৮০০ গ্রাম ওজনে পৌছায়।
৩১. ককরেল পালনে টিকা প্রদান কর্মসূচি কি ধরণের হতে হবে?
• ককরেল মাত্র ৮ সপ্তাহ পালতে হবে বিধায় ব্রয়লার পালনের কর্মসূচি অনুযায়ী টিকা প্রদান করা যেতে পারে।
৩২. ককরেল পালনে কি কি রোগের টিকা প্রদান করা হয়?
• রানীক্ষেত, গামবোরো এবং ফাউল-পক্স রোগের টিকা দিতে প্রস্তুতকারী/সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বা পশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রদান করতে হবে।
৩৩. ককরেলকে অন্যান্য টিকা দেয়া হয় না কেন?
• যেহেতু ককরেল মাত্র সর্বোচ্চ ৯ সপ্তাহ পর্যন্ত পালা হয় তাই রোগের ঝুঁকি বিবেচনায় অন্যান্য টিকা প্রদান করা হয় না।
৩৪. শুধু টিকা প্রদান করে ককরেলের স্বাস্থ্য রক্ষা করা যায় কি?
• শুধু টিকা প্রদান করে স্বাস্থ্য রক্ষা করা সম্ভব নাও হতে পারে।
৩৫. টিকা দ্বারা স্বাস্থ্য রক্ষার সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা না পাওয়া গেলে আর কি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে?
• জীবনিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৩৬. জীবনিরাপত্তা ব্যবস্থা কি?
• যে ব্যবস্থায় ককরেলের স্বাস্থ্য, খাদ্য গ্রহণ, দৈহিক বৃদ্ধি ও খাদ্য রূপান্তর আশানুরূপ হয় এবং মৃত্যুর হার খুবই কম থাকে সে সকল ব্যবস্থাকে জীবনিরাপত্তা ব্যবস্থা বলে।
৩৭. জীবনিরাপত্তার প্রধান বিষয়গুলো কি কি হতে পারে?
• বাসস্থানের সঠিক পরিমাপের জায়গা, সুষম খাদ্য, পর্যাপ্ত আলো বাতাস সরবরাহ, টিকা প্রদান, বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ, বন্যপ্রাণীর প্রবেশ বন্ধ ইত্যাদি সঠিকভাবে বজায় রাখতে হবে।
৩৮. ককরেল পালনে বেশি লাভের জন্য কি কি করতে হবে?
• বাচ্চা এবং খাদ্য খরচ কমাতে হবে, বাচ্চার দৈহিক বৃদ্ধি আশানুরূপ হবে ও সঠিক বাজার মূল্য পেতে হবে।
৩৯. ককরেল বাজারজাতকরণে কি কি সমস্যা হতে পারে?
• পালন খরচ বেশি হওয়াতে বিক্রয় মূল্য বেড়ে যায় যা অনেক সময় ভোক্তার/ক্রেতার কাছে বোধগম্য বা গ্রহণযোগ্য হয় না।
৪০. ককরেল কি হিসাবে বিক্রি হয়ে থাকে?
• জীবিত অবস্থায় জোড়া অথবা প্রতিটার খুচরা মূল্য হিসাবে দরাদরি করে অথবা পাইকারিভাবে বিক্রি হয়ে থাকে।
৪১. পাইকারী বিক্রি কখন হয়?
• বছরের বিশেষ পার্বণ এবং পারিবারিক বড় বড় অনুষ্ঠানে রোষ্ট তৈরির ক্ষেত্রে বিক্রি হয়।
৪২. বাচ্চা পালনের ক্ষেত্রে কতদিন ব্রুডিং করা হয়?
• ঋতুভেদে প্রায় ৪ সপ্তাহ।
৪৩. বয়সভেদে প্রতি বাচ্চার জন্য খাদ্যপাত্রের জায়গা কতটুকু দরকার?
• ৩-৪ সপ্তাহ বয়সের প্রতিটির জন্য ২ সে.মি. ও ৫-৮ সপ্তাহ বয়সের প্রতিটির জন্য ৮ সে.মি.।
৪৪. পানির পাত্রের আকার কি রকম হতে হবে?
• প্রতি দশটির জন্য একটি গোলাকার পাত্র থাকতে হবে।
৪৫. ককরেল পালনে স্থায়ী খরচ কি কি হতে পারে?
• জমি, ঘর ও পালন সরঞ্জাম ইত্যাদি।
৪৬. বছরের কোন কোন সময়ে ককরেল পালন উত্তম?
• ধর্মীয় সকল পার্বণ এবং পহেলা বৈশাখে ককরেল পালন বেশি লাভজনক বলে মনে হয়।
৪৭. অন্যান্য সময়ে ককরেল পালা যায় কি?
• অন্যান্য সময়ে ককরেল পালা যায়। অতি গরমে ব্রয়লার পালা ঝুঁকিপূর্ণ কারণ মৃত্যুর হার বেশি থাকে কিন্তু ককরেলের মৃত্যুর ঝুঁকি কম থাকে।
৪৮. ককরেল খামার পরিচালনা করে বছরে কি পরিমাণ লাভবান হওয়া যেতে পারে?
• দুইশত হিসাবে প্রতি ব্যাচ থেকে ১৪, ০০০.০০ টাকা লাভ করলে বছরে ৬ ব্যাচ খেকে প্রায় ৮৪, ০০০.০০ টাকা লাভ করা সম্ভব হবে।
৪৯. ককরেল পালনে বর্তমানে সমস্যা কি কি?
• রোগমুক্ত, অতিবর্ধনশীল জাতের বাচ্চা পাওয়া কঠিন, সস্তায় সুষম খাদ্যা সরবরাহ নেই এবং খামারের জীবনিরাপত্তা রক্ষা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
৫০. ককরেল পালনে খামারীদের উৎসাহিত করার জন্য কি কি পরামর্শ থাকতে পারে?